শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৭ অপরাহ্ন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড যেমন গুম, ক্রসফায়ার, এসবের অভিযোগ পুলিশ ও র্যাব উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধেই রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেশ স্পষ্টাস্পষ্টিই সেটা জানানো হয়েছে। র্যাবের সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তারা নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। আমাদের সরকার অবশ্য যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে তাতে সাড়া দিচ্ছে এমন নয়, অনড়ই রয়েছে। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক ব্যাপার থাকতে পারে, সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দিকে না ঝোঁকে সে-বিষয়ে সতর্কবাণী জানানোর জন্যই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওই অভিযোগগুলোকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই বক্তব্যের পেছনে কিছুটা সত্য থাকা খুবই সম্ভব; কিন্তু তাই বলে মানুষ যে নিখোঁজ হয়ে যায় সেটা তো আর মিথ্যা নয়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তো তা জানানোর চেষ্টা করে। তারা সভা করে, সভায় কান্নাকাটির ঘটনা যে ঘটে না এমনও নয়। কিন্তু হারানো স্বজনরা ফেরত আসে না। দু-একজন যারা ফেরত আসেন তারাও মুখ খোলেন না। মনে হয় ভয় পান। সাগর ও রুনি যে নিহত হয়েছেন এটা তো কোনো বানানো গল্প নয়, সবাই জানে, ঘটনায় তদন্তের দাবি উচ্চকণ্ঠেই ও নানা মহল থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কই তদন্ত রিপোর্ট তো জমা পড়ল না। সময় চাওয়া হচ্ছে, সময় দেওয়াও হচ্ছে, চাওয়া-দেওয়ার এই ব্যাপারটা মনে হয় গুনে গুনে সেঞ্চুরি করার দিকেই এগোচ্ছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে পুলিশ বাহিনী একেবারেই নির্দোষ এমনটা দাবি করা হয়, প্রদীপ কুমাররা নেই বলেই জানানো হয়; কিন্তু ঘটনা তো ঘটে। পুলিশ জড়িত নয় তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তাদের তো দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব প্রথমত, ওই রকমের ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা দেখা; দ্বিতীয়ত, ঘটনা ঘটলে মানুষগুলোকে উদ্ধার এবং দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পুলিশের কাজ তো মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়াই। তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা সবই তো জনগণের টাকাতেই সম্ভব হয়; তাহলে?
সরকারের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয় যে গুম হয়ে যাওয়া লোকরা ইচ্ছে করে লুকিয়ে থাকে। সেটা বুঝলাম, কিন্তু তাদের খুঁজে বের করে আনা তো পুলিশের গোয়েন্দাদের কর্তব্য; গোয়েন্দারা যে অদক্ষ এমন বদনাম কেউ করবে না। তাহলে? সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটি নতুন এবং বেশ চাঞ্চল্যকর সংবাদ আমাদের দিয়েছেন; সেটা এই যে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো যাদের ‘গুম’ বলছে তাদের অনেকেই নাকি আসলে পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ তথ্য অন্যরা কতটা মেনে নেবে জানি না, না নেওয়ারই কথা। বাম গণতান্ত্রিক জোট মেনে নেয়নি। তারা বলেছে, ‘খুবই নিষ্ঠুর, অশালীন ও চরম দায়িত্বহীনতার প্রকাশ এবং গুম হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য খুবই বেদনার ও কষ্টের।’ তাদের মতে, ওটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার শামিল। মনে হয় না তারা বাড়িয়ে বলেছে।
তবে এটা অবশ্যই সত্য যে বহু মানুষ তথাকথিত অবৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় সমুদ্রের পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন। কিছুকাল আগের ঘটনা, লিবিয়া থেকে ইতালিতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে ঠান্ডায় জমে সাতজন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। যে নৌকায় তারা যাচ্ছিলেন সেখানে অন্য দেশের মানুষও ছিলেন, কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন বাংলাদেশি। এমন খবরও শোনা গেল যে নৌকার ওই যাত্রীদের ২৮৭ জনের ভেতর ১৭৩ জনই ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। খবরে তো এটাও প্রকাশিত যে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ভেতর গত বছর প্রথম স্থানে ছিল বাংলাদেশি যুবকরা। দরখাস্ত করেছিল ২০ হাজার জন।
এ কথাটা তো সত্যি সত্যি কুৎসিত রকমের মিথ্যা এবং যারা যান ও যাওয়ার চেষ্টা করেন তাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক যে তারা ছুটছেন লোভের কারণে। লোভ নয়, ছুটছেন তারা জীবিকার খোঁজে। দেশে জীবিকার সংস্থান নেই, তাই বিদেশে ছোটে, পথিমধ্যে কেউ কেউ প্রাণ হারায়, যারা প্রাণে বাঁচে তারা অমানুষিক পরিশ্রম করে, যা উপার্জন হয় পারলে তার প্রায় সবটাই দেশে টাকা পাঠায়। সেই টাকা উৎপাদন খাতে যে বিনিয়োগ হবে এমন পরিবেশ পরিস্থিতি দেশে নেই, কিন্তু খুব ভালো সুযোগ আছে পাচার হওয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন যে, পুঁজি পাচারকারীরা হচ্ছে দেশের জন্য ‘এক নম্বর দুশমন।’ কথা ছিল দেশের পুঁজি দেশেই বিনিয়োগ হবে। হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চলছে; কিন্তু বিনিয়োগ আসছে না। যেখানে দেশি ধনীরাই বিনিয়োগবিমুখ, এবং পুঁজি পাচারে উন্মুখ, সেখানে বিদেশি পুঁজি আসবে কোন ভরসায়? পুঁজি আর যাই হোক নির্বোধ নয়, নির্বোধ হলে সে বিশ্বজয় করতে পারত না। জানা গেল যে, দেশি ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারে তার জন্য বিধিমালা তৈরি হচ্ছে, একটা যুক্তি এই যে এতে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধ হবে, এবং বিদেশ থেকে মুনাফা আসার দরজাটা প্রশস্ত হয়ে যাবে। এমনটা হলে খুবই ভালো হতো; কিন্তু হবে বলে ভরসা করার কারণ দেখি না। ধনী ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে এতটা দেশপ্রেমিক হয়ে যাবেন যে সযতেœ ও শুশ্রƒষায় গড়ে-ওঠা স্বভাবটা হঠাৎ করে বদলে ফেলবেন এমনটা ঘটার তো কোনো কারণ ঘটেনি। ধনীদের বিদেশে বিনিয়োগ আগেও চলছিল, এখন সেটা সহজতর হবে, এই যা। আসল চাহিদাটা হচ্ছে দেশপ্রেমের, অর্থাৎ দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার, তার বৃদ্ধির তো কোনো লক্ষণ বা দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্ছি না। শুধু পুঁজি নয়, মেধাও পাচার হচ্ছে অবিরাম। আমরা সম্পদহারা হচ্ছি।
উন্নতি ঘটছে, কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ছে না। ফলে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি নেই। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা। উদরে স্ফীত কিন্তু হৃদযন্ত্রের কর্মকা-ে দুর্বল ব্যাপারটা এ রকমের। এটি নিশ্চয়ই ভালো খবর নয়, ব্যক্তির জন্য যেমন নয়, দেশের জন্যও তেমনি নয়। এমনিতেই বেকার সমস্যা ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। করোনা এসে তাকে এবারও ভয়ংকর করে দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়েরই এক পর্যালোচনা বলছে যে করোনাকালে ১৬ লাখ তরুণ কাজ হারিয়েছে, এবং ২ কোটি মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। এটা অবশ্য শুধু বাংলাদেশের ব্যাপার নয়, বিশ্বময় একই ঘটনা দেখা গেছে; করোনা লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, কিন্তু মুনাফা ঠিকই এনে দিয়েছে ধনীদের গৃহে। টিকা এবং ওষুধপত্র উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা, মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওষুধ কোম্পানির মালিকরা। করোনাকালে বিশ্বের শীর্ষ দশজন ধনীর সবাই আরও বেশি ধনী হয়েছেন, কারও কারও স্ফীতি শতকরা একশ ভাগ, বেচারা বিল গেটস নানা ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে সুবিধা করতে পারেননি, তবু ঈশ্বরের কৃপায় তার স্ফীতিও শতকরা ত্রিশ ভাগ। এসব প্রতিবন্ধক ঠেলে ভালো খবর আসে কী করে?
প্রাণ বাজি রেখে বাংলাদেশের যে মানুষরা বিদেশে ছুটছে কাজের খোঁজে, তাদের অনেকেই বাধ্য হয়েছে জমিজমা, যা ছিল বন্ধক রাখতে বা বিক্রি করে দিতে। ঘরবাড়ি ঠিক নেই। ভেবেছে ফিরে এসে ঠিক করবে। আশা করি পারবে, আমাদের শুভেচ্ছা থাকবে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ মানুষের যে ঘরবাড়ি নেই তার খবর কী? না, সে-খবর আমরা অর্থাৎ যাদের ঘরবাড়ি আছে তারা রাখি না, রাখতে চাইও না। যেমন এই খবরটা, যেটি সব দৈনিকেই বের হয়েছে, ‘অবশেষে চাকরি পেল আসফিয়া।’ পুলিশ কনস্টেবলের কাক্সিক্ষত চাকরি। আসফিয়ার ভাগ্য ভালো, চাকরিটা সে পেয়েছে। পাওয়ার অবশ্য কথা ছিল। সব পরীক্ষার বেড়া সে ডিঙিয়েছে, এবার যোগ দেওয়ার পালা। কিন্তু দেখা গেল চাকরি সে পাচ্ছে না। কারণ তার স্থায়ী ঠিকানা বলতে কিছু নেই। পুলিশ দপ্তরের কোনো দোষ নেই, নিয়ম এই যে কর্মচারীদের বর্তমান ঠিকানা এবং স্থায়ী ঠিকানা দুটোই লাগবে, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের তো বটেই, তাদের ভুঁইফোঁড় কিছুতেই হলে চলবে না, অজ্ঞাতপরিচয় তো কোনো মতেই নয়, (পুলিশের লোকরা যদিও অজানা শত শত মানুষকে, চাইকি হাজার হাজারকেও আসামি করার অধিকার রাখেন, সেটা ভিন্ন ব্যাপার)। আসফিয়ার অবশ্য স্থায়ী ঠিকানার একটা ব্যবস্থা কোনো মতে শেষ পর্যন্ত হয়েছে; কিন্তু হাজার হাজার আসফিয়ার খবর কী, যারা উৎপাটিত হয়ে গেছে, যারা ভাসমান থাকে, যাদের স্থায়ী ঠিকানা তো নেই-ই, এমনকি ‘বর্তমান ঠিকানা’ বলেও কোনো কিছু নেই। সব ব্যবস্থাই অস্থায়ী। থাকে পথে-ঘাটে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলে তো নয়ই, স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও আবাসনের কথাটা রাষ্ট্রের অধিপতিরা আমলেই নেননি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, জমির চাহিদা এবং ব্যবহার দুটোই বেড়েছে। জমি তলিয়ে গেছে নদীতে, ভূমিদস্যুরা তাদের দস্যুতাকে নব নব উচ্চতায় উন্নীত করেছে। ঘরবাড়ি যা তৈরি হয়েছে প্রায় সবটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে, অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে, এবং ভূমির নিদারুণ অপচয় ও অপব্যবহার ঘটিয়ে। সাধারণ মানুষ কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে, রাষ্ট্রের তা নিয়ে যে তিলমাত্র মাথাব্যথা আছে এমন নিদর্শন কখনোই পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে তাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো, নইলে অতদূর এলো কেমন করে? কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে, দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীরই আবাসিক সুবিধা নেই; অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজনেরই মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাব। ওদিকে কাজের খোঁজে মানুষ ছুটে এসেছে ঢাকায়, ফলে ঢাকা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ জনঘনত্বসম্পন্ন শহরগুলোর একটি। লোকের ভারে তার ডুবু ডুবু দশা। বায়ুদূষণেও রয়েছে সে শীর্ষে। অনড় অবস্থান। (তবে ঢাকায় বায়ুর দোষের সবটাই যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তা কিন্তু নয়, সীমান্তের অপর পার থেকেও পাচার হয়ে সরাসরি চলে আসে; প্রয়োজনের পানি না দিলেও অপ্রয়োজনে দূষিত বায়ু এবং বন্যার ঢলের পানি পাঠাতে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র কোনো কার্পণ্য করে না। তাদের সীমান্ত সুরক্ষিত, আমাদেরটা নয়। তারা পণ্য ও কর্মী পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যায়। আমরা শুনি।) গৃহহীনদের তো অবশ্যই, অন্যদের অবস্থাও প্রাণান্তকর।
লেখক- ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়